মিফতা স্টাফ রিপোর্টার ::
টিকইল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম।তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের স্মৃতিবিজড়িত এ গ্রামে প্রায় ৯০টি হিন্দু পরিবারের বসবাস।এসব পরিবারের লোক সংখ্যা চার শতাধিক। গ্রামটির সব নারীই যেন চিত্র শিল্পী।গ্রামটির নারীদের কাছে প্রতিটি বাড়ির দেয়াল আর মেঝেই যেন ক্যানভাস। তাদের হাতের ছোঁয়ায়-শিল্পকর্মে প্রতিটি বাড়ির কাঁচারি ঘর, রান্নাঘর থেকে শুরু করে শোবার ঘর পর্যন্ত, প্রতিটি ঘরের দেয়াল আর মেঝেই আলপনায় ভরা।প্রথমে গ্রামের একটি আলপনা বাড়ি থেকে এখন আলপনা গ্রাম। প্রায় দেড়শ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ গ্রামে এসব হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস।বংশ পরম্পরায় বছরের পর বছর ধরে বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে এ ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছেন এ গ্রামের ঝি-বৌয়েরা। মাটির তৈরি এসব বাড়ির ভেতরে ও বাইরের কোনো দেয়ালই বাদ পড়ে না তুলির আঁচড় থেকে। এ গ্রামের আলপনা শিল্পী নয়ন মনি ও বিপতী রানী দাস জানান, আগে আলপনা শুধু কয়েকটি বাড়িতেই আঁকা হতো। ধীরে ধীরে এ গ্রামের সব বাড়ির নারীরাই আলপনা এঁকে বাড়িকে সাজিয়ে রাখেন। বছরে দুই বার- লক্ষ্মী পূজা ও দুর্গা পূজায় বাড়ি সাজানো হয়। দুই পূজায়ই গ্রামের সব বাড়িঘর আলপনা দিয়ে সাজানো হয়। আগে এ গ্রামের নাম টিকইল থাকলেও সম্প্রতি ‘আলপনা গ্রাম’ নামেই সবাই গ্রামটিকে চেনে। এখন আলপনা গ্রাম নামেই চেনে দেশের ও বিদেশের লোকজন।
আলপনা শিল্পী প্রভাতী রানী, ধীরেন্দ্র বর্মন, প্রদীপ চন্দ্র বর্মন জানান, আলপনা আঁকতে আগে স্থানীয় লাল মাটি, খড়িমাটি, চাল ভিজিয়ে ছেঁচে বানানো সাদা রং ব্যবহার হতো। এসবের সঙ্গে বিভিন্ন প্রাকৃতিক গাছের কষ মেশানো হতো আলপনা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য। বর্তমানে বাজারে পাওয়া রং দিয়েই আঁকা হয় আলপনা। ভাত-কাপড়ের অভাব থাকলেও বাড়িঘর সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করেন তারা। যেন আগে আলপনায় বাড়ি সাজানো, তারপর অন্য কিছু। একটি বাড়ি সাজাতে বর্তমানে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা দরকার হয়। বছরে দুই বার সাজাতে প্রায় ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা খরচ হয়। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ কৃষি কাজ করে খেয়ে পড়ে কোনো রকম আছেন। দারিদ্র্য থাকলেও তাদের বিশ্বাস, এ আলপনা দিয়েই তাদের ঘরে লক্ষ্মী প্রবেশ করে। টিকইল গ্রামের বৌ-ঝিরা বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে আলপনা এঁকে বাড়ির সৌন্দর্য বর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে দেবতার সুদৃষ্টি ও আশীর্বাদ কামনা করে থাকেন।
তারা আরও বলেন অনেক বছর ধরে আলপনা আঁকা হলেও তা ছিল সীমিত পরিসরে। পরে এ গ্রামের বধূ দেখন বর্মনের হাত ধরে বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন রংয়ের, বাহারি আলপনার প্রচলন ও প্রসার হয়েছে। আগে এ গ্রামের নারীরা খুব বেশি করে আলপনা করতেন না। কিন্তু তার দেখাদেখি গত কয়েক বছর ধরে এ গ্রামের প্রতিটি বাড়ির বেশিরভাগ দেয়ালেই আলপনা জায়গা করে নিয়েছে। এ কারণে দেখন কে আলপনার উদ্যোক্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জেলা প্রশাসন। সনদ, সোলার প্যানেল দেওয়াসহ নানাভাবে তাকে সহায়তা করেছে প্রশাসন।সনাতন ধর্মাবলম্বী দেখন বর্মনকে সরকারি ভাবে চার কক্ষের একটি বাড়ি দেওয়া হয়েছে। নাচোল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাজের স্বৃকিতি হিসেবে একটি ক্রেস্ট ও এর সঙ্গে ১০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছেন। পর্যটকদের জন্য দেখন বর্মন একটি পরিদর্শন বইও খুলেছেন। গ্রামটি আলপনা গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় স্থানীয় প্রশাসন গ্রামের রাস্তাটি মেরামত এবং গ্রামের রাস্তায় ২১টি সোলার লাইট স্থাপন করেছে।আলপনা শিল্পী দেখন বর্মন জানান, এক সময় হয়তো মাটির বাড়ি থাকবে না, কিন্তু পাকা বাড়িতেও এ আলপনা এঁকে ঐহিত্য ধরে রাখবেন এ গ্রামের নারীরা। এ গ্রামের আলপনা যেন দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং বিদেশেও এর বিস্তার ঘটে সে আশাই করেন দেখন সহ এ গ্রামের বাসিন্দারা।
Devoloped By WOOHOSTBD