রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন বলে কথা, স্বাভাবিকভাবেই পঁচিশে বৈশাখে কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন হবে সেটাই স্বাভাবিক ব্যাপার।পল্লীগ্রামের তল্লীতলা ক্লাবে রাবিন্দ্রীক অনুষ্ঠান হবে ।সে কথা চলে যায় ঝিন্নির মেয়ের কাছে।
নাচতে খুব ভালোবাসে। কিন্তু কোনোরকম প্রশিক্ষণ ছড়াই সে লোক নৃত্য,চলোচিত্র নৃত্য করতে পারে।টিভি বা ইউটিউব দেখেই সে নাচ তৈরী করতে পারে।তার মা যখন মানুষের বাড়ি বিকেলে কাজ করতে যায়,তখন
রিথিকেও সাথে নিয়ে যায়।আর সেখানে রিথি শুধুই ইউটিউবে গান নাচ দেখে।আর যখন শুনল ২৫ শে বৈশাখে নাচ গান হবে,তখন সেও ঝিন্নিকে বলল আমিও ২৫ শেষ বৈশাখে নাচ করব মা।ঝিন্নি বলল গরীবের মেয়েদের ওখানে নাচ করতে নেই,ওখানে বড়োলোকরা নাচ করেরে মা।রিথি বলে তেমন তো বলেনি কিছু।
তাহলেতো আমি নাচ করবোই।ঝিন্নিও মেয়ের জেদের সাথে পারলনা।ঐটুকু ক্লাস ফোরে পরা মেয়ে নিজেই ঠিক করে নিলো কোন রবীন্দ্র সঙ্গীতে নাচ করবে।
রিথির বাবা ইটভাটার শ্রমিক।তাই মেয়েকে নিয়ে প্রচলিত চিন্তাধারার বাইরে কোনো চিন্তা নেই।
সব চিন্তাই যেন মা ঝিন্নির।মেয়েটাকে একটু লেখাপড়া করাবে।মেয়ের শখতো আরেকটু বেশি।তিনিও নাচে আগ্রহী এবং বাবুদের মেয়ের মতো তিনিও নাচ করতে চায়।ঝিন্নি মেয়েকে নিয়ে তল্লীতলা ক্লাবে নাম লেখাতে যান।সিরিয়াল ছয়ে নাম ।২৫ শে বৈশাখের দিন বিকেল চারটের থেকে অনুষ্ঠান শুরু হয়।প্রথমে গান,তারপর নাচ এবং আবৃত্তি হয়।নাচে রিথির ছয় নম্বরে নাম থাকলেও শহরে বাবুদের মেয়েদের আগে দেয়।আর রিথিকে সবার শেষে দেয়।শেষ পর্যন্ত রিথির নাম ডাকা হয়।রিথি মনের আনন্দে কবি গুরুকে নাচের মাধ্যমে শ্রদ্ধান্জলি জানাতে চায়।দর্শক মহলসহ বিচারক মন্ডলী
সবারই বিপুল হাততালি চলে।তাই রিথি ধরেই নেয় সে প্রথম পুরস্কার পাবে।এদিকে বৃষ্টির ভাব দেখে বাবুরা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে যায়।আর কিছু প্রতিযোগি রয়ে যায়।তাদের মধ্যে রিথিও থেকে যায়।
ঝিন্নি কিছুতেই রিথিকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেনি।
রিথি প্রথম পুরস্কার দর্শকদের সামনে থেকে নেবে এমন ভাবছিলো।আবৃত্তি শেষ হতে হতে রাত ৯.৩০ বাজল।
অনুষ্ঠানের ফলাফল ঘোষণার সূচি এলো সন্চালিকার
হাতে।গানের তালিকা ঘোষণা করা হোলো।সাথে সাথে পুরস্কার দেওয়া হোলো।এবার নাচের পালা।ঐ ছোট্ট রিথি আনন্দে মুখর, বাবুদের মেয়ের থেকেও তিনি ভালো
নেচেছেন।তার নাচেই হাততালি সর্বোচ্চ ছিলো তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি ছোট্ট রিথির।নাচের কচিকাঁচা নৃত্য বিভাগে তার নামই যে প্রথমে থাকবে সেটাই সে আশা করেছিলো।এবার নাম ঘোষণা হোলো প্রথমে তৃতীয় অবস্থানের নাম এলো,তৃতীয় অবস্থানকারী কে মেডেল,সার্টিফিকেট দেওয়া হোলো।এরপর দ্বিতীয় স্থান অধিকারীর নাম ঘোষণা হোলো।রিথি আনন্দে হাততালি দিতে গিয়ে দেখলো নিজের নাম।ছোট্টো রিথির আশা ভঙ্গ হোলো।সে মঞ্চে চলে গেলো।তাকে দ্বিতীয় পুরস্কার হিসেবে মেডেল ও সার্টিফিকেট দেওয়া হোলো।শুকনো মুখে ভদ্রতার হালকা হাসি মেখে মঞ্চ থেকে নামে রিথি।
প্রথম হোলো এক বাবুর মেয়ে।রিমি বুঝলো সাহেবদের মে জন্য তাকেই প্রথম করা হোলো।কিন্তু যে প্রথম হোলো
তার নাচে তেমন হাততালি পরেনি।ঝিন্নি সব বুঝতে পারলেও মেয়ের দ্বিতীয় অবস্থানটাকে খুব স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়ে আনন্দ করলেন।শ্রমিকের মেয়ের এইটুকু সাফল্য যথেষ্ট হিসেবে নিলো মা ঝিন্নি।
ঝিন্নি মন দিয়ে টিভিতে নাচের রিয়েলিটি শো দেখছে।পেছন থেকে ডাকল মা,ও মা খেতে দিয়ে যাও।
ঝিন্নি ঝ্যাংটা দিয়ে উঠল -দারা দেখে আসি।রিথি বলল পরে দেখে নিও।ঝিন্নি বলল এটাই তোর প্রথম বিচারকের রিয়ালিটি শো মা।তাই আজ পুরো এপিসোডটা দেখে আসবো।
সেদিন যে শ্রমিকের মেয়েকে শ্রেষ্ঠ নাচ করা সত্ত্বেও দ্বীতিয় করা হয়েছিলো,আজ সেই রিথি মল্লিকের নাম সারা দুনিয়া জানে।সেদিন দ্বিতীয় হওয়ার পর
সেই ক্ষুদে রিথি চোখে জল নিয়ে বাড়িতে ফিরে ছিলো
তার ন্যায্য পুরস্কার তাকে দেওয়া হয়নি বলে।কিন্তু মা ঝিন্নি সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নিলেও শ্রমিকের ক্লাস ফোরে পরা মেয়ে তার প্রাপ্তি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি।স্বপ্নের আগ্নেয় গিরি রিথির মনে উৎপত্তি হোলো,তার থেকে প্রতিদিন লাভা নির্গত হোতো তা ক্ষুদে রিথিকে প্রতিদিন অনুশীলনে ভাসিয়ে দিতো।ক্ষুদে রিথির জেদ হোলো তাকে দ্বিতীয় করে তার ন্যায্য পাওনা থেকে
বঞ্চিত করলেও সে একদিন এ জগতে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করবে।তাই প্রতিদিন সে ইউটিউব থেকে নাচ তুলত।
আর যেখানেই খোঁজ পেত সেখানেই নৃত্য প্রদর্শন করত।
ইউটিউব থেকেই রবীন্দ্রনৃত্য,এসামিস নৃত্য,লোকোনৃত্য,চলচিত্র নৃত্য,হিপহপ ইত্যাদি সে দিনের পর দিন জানতে লাগল ও নিজের চেষ্টায় নিজে অধ্যয়ন রত হতে লাগল।গরীবত্ব তাকে থামাতে পারেনি, পরিবারের অশান্তি তাকে দমাতে পারেনি।তার নাচের প্রতি প্রেম ও অদম্য ইচ্ছে শক্তি তাকে পৌঁছে দিলো তার প্রথম প্রতিযোগিতার প্রাপ্তি পেতে।আজ তার নাচের খ্যাতি জগৎ জুড়ে।কিন্তু ঝড়,বৃষ্টি উপেক্ষা করে রিথি তার অভ্যাস চালিয়ে গেছে।সাথে পড়াশোনাও করেছেন।
পড়াশোনায় ভালো না থাকলে খারাপও ছিলোনা।
তবে তার নাচের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও ন্যায্য প্রাপ্তির জেদ তাকে তিলে তিলে তাল করে দিয়েছে।ক্লাস নাইনে যখন পড়ে তখন টিভিতে দেখতে পায় তার জেলায় নাচের অডিশন হবে টেলিভিশনের জন্য,তাই স্কুল কামাই করে অডিশন দিতে গিয়েছিলেন।কিন্তু প্রথম রাউন্ডে
নির্বাচিত হলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে আর নির্বাচিত হয়নি।
কিন্তু তা বলে থেমে থাকেনি।তাকে পারতেই হবে মনোভাব তাকে আরও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করালো।সবসময়ই যে প্রথম হতে পেরেছে তা নয়।
তবে ইচ্ছে ছিলো প্রথম প্রতিযোগিতার ন্যায্য প্রাপ্তি ফেরৎ নেওয়া আর নাচের প্রতি অগাধ ভালোবাসা তাকে বার বার ধাক্কা দেয় তার লক্ষ্যে।তাই দ্বিতীয়বারের মতো
আবার ডান্স রিয়ালিটি শোতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়।সেই অডিশনের টাকার জন্য রিতু কিছুদিন একটি
পিচ ঢালাইয়ের রাস্তায় কাজ করে।সেখান থেকে
উপার্জিত আড়াই হাজার টাকা আর তার মা ঝিন্নির দেওয়া দেড়হাজার টাকা মোট চারহাজার টাকা
নিয়ে অডিশন দিতে যায়।সবার প্রথমে পৌঁছায় অডিশনের দিন।এই অডিশনের প্রতিটি স্টেজ পাশ করতে পারলে তাহলে ফাইনাল।এবার সত্যিই কিন্তু নিজের প্রতি ভরসা করতে পারলো।এবার পারতেই হবে বলে ময়দানে নামল।আর সত্যিই তার স্বপ্ন পূরণ হোলো প্রতিটি ধাপ পার করে ফাইনালে পৌছোঁলো। ফাইনাল চলাকালীন ঘোষিত হোলো এই ডান্স রিয়ালিটি শোতে
যে জিতবে সে বিশ্ব ডান্স রিয়ালিটি শোতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাবে।এই শুনে রিথির জেদ আরও বেড়ে গেলো।শেষ পর্যন্ত রিথি ফাইনাল জিতল।ফাইনাল জিতে
রিথি বিশ্ব ডান্স রিয়ালিটি শোতে অংশগ্রহণ করে।
এরফলে তার চেনা পরিচিতিটা আরও বেড়ে গেল।
তার সাথে বাড়তে লাগল মনের মধ্যে ক্ষিধে।আর হ্যা শুধুই সেইদিনের প্রাপ্তি ফিরিয়ে আনা যেদিন খুব ভালো নাচ করার পরও তাকে দ্বিতীয় স্থান দেওয়া হয়েছিলো।
ভোলেনি সেসব কথা আজও।তাই এটাই সেই স্টেজ যেখানে প্রমাণ করতেই হবে তার নাচ শ্রেষ্ঠ নাচ।
এদিকে ঝিন্নি কিন্তু ঠিক মানুষের বাড়িতেই কাজ করে চলছে।কাজের বাড়ির মানুষ কিন্তু এখন আর ঝ্যামটা দেয়না।সে জে এখন সেলিব্রিটি ডান্সারের মা।তার মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ক্যামেরা ফেস করতে হয় ।
আর্থিক পরিস্থিতি না পাল্টালেও সামাজিক পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।আর মেয়ে এদিকে বিশ্ব ডান্স রিয়ালিটি মন্চে নাচ করছে।হ্যা এবার কিন্তু শ্রমিকের মেয়ে জন্য দ্বিতীয় করার সাহস পায়নি। অর্থাৎ প্রথমই হয়েছে সে।
বিশ্বের মন্চে সেরা ডান্সারের ট্রফি নিয়ে রিথির চোখে জল।আর ভাবছে প্রথম রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসবে নৃত্য প্রতিযোগিতায় সে তার সেরাটা দিয়েও সেরা হতে পারেনি।তবে এই বিশ্বের একশটি দেশের নৃত্য প্রতিযোগিকে হারিয়ে তার হাতে সেরার শিরোপা উঠলেও তার সেই নয় বছর আগের ঘা ভুলতে পারেনি।
তার শুধুই ঐ অনুষ্ঠানে এটাই পাওয়ার ছিলো রিথি মল্লিক প্রথম।কিন্তু আজ সে বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগিকে হারিয়ে সারা বিশ্বে নাম কুড়োলেও কোথাও যেন আজও তার মনে গেঁথে আছে তার আত্মবিশ্বাসকে থাপ্পর মারার জায়গা ও সময়টা।কিন্তু
সময় সেদিন তাকে তার প্রাপ্য দিতে না পারলেও আজ তার প্রাপ্য তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।কলেজে ওঠার পর নাচের কারণে সেভাবে আর কলেজ যাওয়া হয়নি রিথির।তবে আজ সে জনপ্রিয়। বিভিন্ন জায়গায় বিচারকের জন্য ডাক পায়।অর্থও হয়েছে তার।ছয় মাস পর ডাক পেলো রিথি এক হিন্দি চ্যানেলের রিয়ালিটি শোয়ের বিচারক হিসেবে।দু মাস পর ব্রেক থাকায় বাড়িতে ফেরে।ফিরেই ফ্রেস হতে যায়।
আর এদিকে ঝিন্নি ব্যস্ত টিভিতে মেয়েকে দেখতে।
মেয়ে রিথি ডাকছে মা,ও মা।ঝিন্নি বলছে রিয়ালিটি শো টা দেখে আসি।
Devoloped By WOOHOSTBD